বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমনের পর থেকে তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের ৩ বছর পূর্ণ হবে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের আগস্টে গণহত্যা শুরু করলে রোহিঙ্গা জনগণ বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া তালিকা থেকে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গার নাম বাছাই করে বাংলাদেশকে পাঠায় মিয়ানমার। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসনের সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়; কিন্তু প্রত্যাবাসন আর শুরু হল না,আশার মুখ দেখলো না রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া।
২০১৭ সালের
সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের
সাধারণ অধিবেশনকে সামনে রেখে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের এ উদ্যোগটি যে উদ্দেশ্যমূলক ছিল সে ইঙ্গিতই ছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে চীনের সর্বশেষ ভূমিকা নিয়ে আমাদের কূটনৈতিক মহল বেশ উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন
বিষয়ে চীনের কাছ থেকে সবরকম সহযোগিতার যে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিলো, তার বাস্তব পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূতের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন এবং মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের আলোচনা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।তখন প্রত্যাবাসন আয়োজনে চীনের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।কিন্তু চীন বরাবরই সহযোগিতার কথা বললেও এ পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে হয় না।
আমাদের একটা ধারোনা ছিলো,আর তা হচ্ছে, বাস্তুভিটায় ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের দেয়া মূল শর্তগুলো পূরণ না হলে প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হবে না।
তাদের প্রাধান দাবীগুলো ছিলো এমন________
১।রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান।
২। নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
৩। অবাধ চলাচলের পথকে মসৃণ করা।
এর ব্যত্যয়
ঘটার সম্ভাবনা থাকলে রোহিঙ্গা
জনগোষ্ঠী কিছুতেই মিয়ানমারে ফিরে ফিরে যাবে না।
রোহিঙ্গাদের মোট পাঁচটি দাবির মধ্যে অন্তত এ তিনটি দাবি যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে হয়তো বাদবাকি দাবিগুলো এমনিতেই পূরণ হয়ে যেত, ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব হতো।
কিন্তু আসল ব্যপার হচ্ছে,প্রত্যাবাসন
প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এবং আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কোনো কর্মকর্তার কিছু বক্তব্য এখনও স্পষ্ট নয়। পুনরায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তারা বলেছেন______ ‘রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে আমরা তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাব না।’এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে পাঠানো হবে না বলেও বক্তব্যে উল্লেখ করেছিলেন। রাষ্ট্রপরিচয়হীন রোহিঙ্গাদের জন্য, নাগরিকত্ব নিশ্চিতকরণের চেয়ে বড় নিরাপত্তা আর কী হতে পারে? রোহিঙ্গা ইস্যুর মূল সমস্যা তো ওখানেই।
জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকাসহ অন্যান্য অধিকাংশ রাষ্ট্রও কফি আনান কমিশনের সুপারিশ অনুসারে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতির পক্ষেই তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের অবস্থান তো এ ব্যাপারে আরও বেশি স্পষ্ট। প্রশ্ন হল, তাই যদি হবে, তাহলে কিসের ভিত্তিতে পুনরায় প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়েছিলো? ধরে নিলাম প্রত্যাবাসনের পর রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতির ওপর বাংলাদেশ আস্থাশীল ছিল।
কিন্তু
মিয়ানমার সরকারের এ প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গাদের আস্থা আছে কি না বা তারা বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে রাজি কি না, এ ব্যাপারটি বিবেচনা করে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া ঠিক করা উচিত ছিলো।
এবারের তৎপরতায় মনে হয়েছে, যে কোনো উপায়ে প্রত্যাবাসন শুরু করা এবং ফিরে যাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের আচরণ লক্ষ করে বাংলাদেশ হয়তো ভবিষ্যৎ কর্মকৌশলের কথা ভেবেছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের কূটনৈতিক পদক্ষেপের কোনো ফলাফল আমরা পেলাম না।
অথচ প্রত্যাবাসন চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশকে দোষারোপ করার আরও একটি সুযোগ মিয়ানমার পেয়ে গেল। এ পরিপ্রেক্ষিতে চীনকে ব্যবহার করে মিয়ানমার আবারও একটি কূটনৈতিক ফাঁদে বাংলাদেশকে ফেলেছে কি না, তাও ভেবে দেখতে হবে।
প্রত্যাবাসনের এ পুরো অ্যাপিসোড পর্যালোচনা করে মনে হয়েছে, বাংলাদেশ মিয়ানমারের অন্তঃস্থিত এ কূটকৌশল পরিমাপে ভুল করেছে।আন্তর্জাতিক চাপে দর কষাকষিতে মিয়ানমার এ অপকর্মটি করে নিজেদের জন্য একটা সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের
ফিরে যেতে নিরুৎসাহ করার জন্য উদ্বাস্তু শিবিরে ব্যাপক লিফলেট বিতরণের খবর বেরিয়েছে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে। ধারণা করা হচ্ছে, উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে কর্মরত বেশকিছু এনজিও এ তৎপরতায় জড়িত।রোহিঙ্গাদের যাতে নিরুৎসাহিত করা না হয় সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যথারীতি হুশিয়ারি উচ্চারণও করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এসব এনজিও রোহিঙ্গাদের সাহায্যের নামে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকে।
অর্থ প্রাপ্তির এ পথ যাতে সংকুচিত না হয় এ কারণেই কিছু কিছু এনজিও রোহিঙ্গাদের নিরুৎসাহিত করছে। এহেন কর্মকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
আর নিরুৎসাহিত করার কারণ যদি মানবিক হয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের মনোভাবের পক্ষে যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই ঠিক করবেন বাংলাদেশের কী করণীয়।
কারণ, মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের সাহায্য ছাড়া উদ্বাস্তু শিবির চালানো বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ কথা সত্য, আন্তর্জাতিক মহল তাদের দায়িত্বের অংশ হিসেবেই এ সাহায্য করছে।
পাশাপাশি এ কথাও সত্য, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সময় যত দীর্ঘায়িত হবে আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ ততই ফিকে হয়ে আসবে। বাস্তবেও তাই হয়েছে। ফলে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণও আগের তুলনায় কমে এসেছে।
মিয়ানমারের
একগুঁয়ে মনোভাব এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নির্লিপ্ততায় রোহিঙ্গা সমস্যা যে শিগগির মিটছে না, তা সহজেই অনুমেয়।
রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধান করা না হলে এবং আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ কমে গেলে ত্রাণ কাজ বাধাগ্রস্ত হবে, সন্দেহ নেই। তাতে দিন দিন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভেতর অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। এতে সংকট বাড়বে এবং ভবিষ্যৎ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।
আবার আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায়কে এ কথাও মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বহুমাত্রিক ঝুঁকিতে আছে। দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক চাপ তো আছেই। পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকি, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বাংলাদেশ বর্তমানে নিরাপত্তাজনিত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে।
চীন
ছাড়াও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের ভূমিকা এখন পর্যন্ত রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে। আগে তিন দিনব্যাপী বাংলাদেশ সফরে আসার পর ভারতের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে রোহিঙ্গা সমস্যা ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার তিন দেশেরই সংকট বলে অবহিত করেন তিনি। একটি বিষয় লক্ষণীয়, আদতে চীন ও ভারতের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক হলেও মিয়ানমার প্রশ্নে তারা উভয়ে এক। বাংলাদেশ ভারতকে সর্বকালীন মিত্র দেশ হিসেবে বিবেচনা করলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাস্তবিকই বাংলাদেশের পাশে নেই।
অদূর ভবিষ্যতে চীন বা ভারত নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে যে দাঁড়াবে না, তা বাংলাদেশ যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবে ততই মঙ্গল। এসব কথা বিবেচনা করে বলা যায়, বাংলাদেশ এক উভয় সংকটের মধ্যে আছে। সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েও সবার সহযোগিতা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বিশেষ করে চীনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের
অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার চীন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আদৌ আন্তরিক কি না, সন্দেহ হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন পথে তা বলা আপাতত কঠিন বলে মনে হচ্ছে।
অতএব,__বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং রোহিঙ্গা জনগণের স্বার্থরক্ষা করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে চীনকে যে করেই হোক রাজি করাতে হবে। এ জন্য চাই আরও জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতা। আমারা সাধারন জনগন বিশ্বাস,
বাংলাদেশ সে পথেই এগোবে।
এই আর্টিকেলটি যার কথার দ্বারা অনুপ্রানিত__ একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা।
সুত্র__যুগান্তর নিউজ।