মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খা এবং জাতীয় সংস্কৃতি বিনির্মাণ

21
মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খা এবং জাতীয় সংস্কৃতি বিনির্মাণ
মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খা এবং জাতীয় সংস্কৃতি বিনির্মাণ

মুক্তিযুদ্ধ বলতে আমরা সাধারণতঃ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকে বুঝে থাকি, যদিও সেটা আসলে মুক্তিযুদ্ধের একটি অধ্যায়, যা রক্তস্নাত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। মুক্তিযুদ্ধকে পেছনে সম্প্রসারিত করলে শত-শত বছর পূর্বেও নেওয়া যায়, অন্তত ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত তো যেতেই হয়। তবে আলোচনার সুবিধার্থে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থে ১৯৪৭ সাল থেকে তার সময় গণনা করা যেতে পারে। আর তা আজও চলমান।

আর একটা বিষয় এখানে পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার যে, অতীতের অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলের আগের কালে আমাদের যে মুক্তিযুদ্ধ তা আধুনিক রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি চেতনায় সমৃদ্ধ ছিল না। আধুনিক অর্থে জাতি বা জাতি-রাষ্ট্রের চিন্তা আমাদের বড় জোর একশ’ বছরের পুরনো। তা-ও ছিল ধোঁয়াশাময়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই কেবল সেটা স্বচ্ছ ও পূর্ণ অবয়ব এবং গন্তব্য খুঁজে পায় রাজনীতি ও সংস্কৃতির আধারকে আশ্রয় করে। ভাষা নিয়ে বিতর্কের শুরু ব্রিটিশ আমলেই, চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি, যখন অবিভক্ত ভারতের মুসলিমপ্রধান পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির সম্ভাবনা মূর্ত হয়ে ওঠে। তবে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভাষা-বিতর্ক ছিল মূলতঃ বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। ১৯৫২ সালে সেটা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়। অবশ্য তার মধ্যেই সুপ্ত হয়ে ছিল জাতীয়তাবোধের বীজ, ঠিক তখন-তখনই সেটা দৃষ্টিগোচর হয়নি। কালান্তরে পর্যায়ক্রমে পৃথক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের বোধ উজ্জীবিত হতে থেকেছে। একদিকে এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের ক্রমোজ্জীবন, অন্যদিকে পাকিস্তানী শাসকদের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণু আচরণ ১৯৭১ সালের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। আমরা স্বাধীনতা লাভ করি।


প্রশ্ন হচ্ছে, যে-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের চেতনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি সেই চেতনা বা সংস্কৃতির বিকাশের অভিমুখ এখন কোন দিকে? ইদানীং তো বাংলা ভাষার অস্তিত্ব নিয়েই সংশয় প্রকাশ করা হচ্ছে। ইংরেজি ও হিন্দির আগ্রাসন এবং ইন্টারনেট ও অন্যান্য প্রযুক্তির দ্রুত সম্প্রসারণের সঙ্গে বাংলা ভাষা পেরে উঠছে না বলেই অনুমিত হচ্ছে। যে-ভাষার ওপর নির্ভর করে আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ সেই ভাষাই যদি না থাকে, বা কোনও রকমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে ইংরেজি-হিন্দির সঙ্গে আপস করে, তাহলে আমাদের সেই সংস্কৃতির কী হবে সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে। সেখান থেকেই আজকের আলোচনার সূত্রপাত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ খুব পরিকল্পিতভাবে না এগোনোর কারণে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকে গিয়েছে। সেই অবকাশের অপব্যবহার করে স্বাধীনতাবিরোধী দুষ্টচক্র এবং অর্বাচীন আবেগপ্রবণ গোষ্ঠী এমন এক যুদ্ধংদেহী পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যে আজ পাকিস্তানপন্থী, ভারতপন্থী, আমেরিকাপন্থী, চীনপন্থী, আরবপন্থীতে ছেয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশপন্থী খুঁজে পাওয়া ভার। এর মূল কারণ, শুরুতেই সাংস্কৃতিক ভিত্তি বিনির্মাণের নিরাবেগ, পরিকল্পিত ও ধারাবাহিক তৎপরতার অভাব। এই সুযোগে গোষ্ঠীভিত্তিক আবেগনির্ভর একদেশদর্শী একরোখা উদ্যোগ পরিবেশকে দূষিত করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এখনও সংশোধন সম্ভব, যদি আমরা নির্মোহ হতে পারি।

জাতীয়তাবাদী চেতনা ছাড়া একটা জাতি যেমন বিকশিত হতে পারে না, তেমনই একথাও শতভাগ সত্যি যে, উগ্র জাতীয়তাবাদ সেই জাতির অগ্রযাত্রাকে বৃত্তাবদ্ধ ও বিপথগামী করে দেয়। সে কারণে জাতীয় আবেগকে প্রয়োজনে উসকে দেওয়া যেমন কখনও প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, তেমনই কখনও আবার তাকে কঠিন হাতে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনও দেখা দেয়। এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে। এই দায়িত্ব পালনের সাফল্য ও ব্যর্থতার ওপর সেই জাতির বিকাশ ও অগ্রগতি নির্ভর করে। এক্ষেত্রে আমরা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি।

আমাদের জাতীয়তাবোধ উজ্জীবিত হয়েছে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। সে কারণে আমাদের জাতীয়তাবোধে ভাষা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। এর ইতিবাচক অবদানের কথা সুবিদিত। কিন্তু এর নেতিবাচক ফলকে আমরা গুরুত্ব দেইনি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক স্বার্থে সবসময় এটাকে ব্যবহার করেছেন, কখনও কখনও সেটা অপব্যবহারে পরিণত হয়েছে। একটা সময় তো এমন অবিমৃশ্যকারিতাও আমাদের ওপর সওয়ার হয়েছিল যে বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোনও ভাষা আমরা শিখবই না। এমন ব্যবস্থাও করা হয়েছিল যে, এদেশে বসবাসকারী সকলকে বাংলা ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতি ও জাতিত্ব কবুল করতে হবে। তার ফল যে ভাল হয়নি, বা সেটা যে করা অসম্ভব সেটা অচিরেই প্রমাণিত হয়েছে। ভাষা একটি জাতি নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বটে, কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। তা যদি হতো তাহলে আরবীভাষী গোটা মধ্যপ্রাচ্য একটি জাতি হতো, কিংবা ইংরেজিভাষী যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, প্রভৃতি দেশ মিলে একটা জাতি হতো। পাশ থেকেও উদাহরণ টেনে আনা যায়- মণিপুর, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, প্রভৃতি স্থানগুলোর ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। তারপরেও তারা এক ভারতীয় জাতি গঠন করতে পেরেছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে ভাষা একই হলেও, আরো এমন কিছু ব্যাপার আছে যা একই ভাষাভাষীদের ভিন্ন ভিন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে, আবার ভিন্ন ভাষাভাষী হলেও একই জাতিত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে এমন প্রভাবশীল উপাদানও বর্তমান। কী সেসব উপাদান? অনুসন্ধান চালানো যেতে পারে। ভারতের কথা যদি বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যাবে প্রধানতঃ ধর্মই ভিন্ন ভাষাভাষীদের একতাবদ্ধ করার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রেখেছে। একথা ঠিক যে ভারত বহু ভাষার দেশ, তেমনই বহু ধর্মের দেশও। কিন্তু সিংহভাগ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ইসলামকে বাদ দিয়ে আর যেসব ধর্ম আছে সেসব ধর্মও ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিনির্ভর হিন্দুধর্মের (রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মকে ধর্ম না বলে সংস্কৃতি বলার পক্ষেই মত প্রকাশ করেছিলেন) মতোই অনেকটা। কিন্তু ধর্ম যত শক্তিশালীই হোক, তা-ও যে একক শক্তি হিসেবে একই ধর্মাবলম্বীদের সবাইকে ধরে রাখতে পারে না তার সব চাইতে বড় প্রমাণ তো আমরাই। তারপরেও উদাহরণ হিসেবে টেনে আনা যায় মধ্যপ্রাচ্যকে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিবেশী দেশগুলোর সিংহভাগ মানুষ একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও তাদের পক্ষে একটি জাতি  গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ইউরোপের কথাও এক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য। তাহলে বোঝা গেল ভাষা এবং ধর্ম জাতি গঠনের অত্যন্ত প্রভাবশীল দুটি উপাদান, কিন্তু কেবল কোনও একটাই একটি জাতি গঠন করতে পারে না। এমনকি, এই দুটো অতি শক্তিশালী ও প্রভাবসঞ্চারী উপাদান মিলেও একটি জাতি গঠন করতে পারে না এমন উদাহরণও অনেক। আবার সেই মধ্যপ্রাচ্যের কথাই বলা যায়। সেখানকার দেশগুলোর ভাষা আরবী এবং ধর্ম ইসলাম, তারপরেও তারা এক জাতি হতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার কথাও বলা যায়। উভয় দেশই ইংরেজিভাষী এবং খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী, কিন্তু আলাদা জাতি। ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূ-প্রাকৃতিক বিশিষ্টতা এবং তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গোত্রীয় ও সামাজিক ঐতিহ্য, সৌন্দর্যবোধ, কৃষি, শিল্প, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস এবং টিকে থাকা ও বিকশিত হওয়ার পুরুষানুক্রমিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস, প্রভৃতি বিষয় এক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রেখেছে। ১৯৪৭ সালে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠনের উদ্যোগ নিয়ে যে ভুল আমাদের পূর্বপুরুষরা করেছিলেন সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি আমরা করেছি কেবলই ভাষার ভিত্তিতে জাতি গঠনের চেষ্টা করতে গিয়ে। অথচ আমরা এই উদ্যোগকেও স্বচ্ছ আকার দিতে পারিনি। আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি এদেশের ভিন্নভাষীরা আমাদের জাতিভুক্ত কিনা, হলে কীভাবে, নাহলেই বা কেন? ঠিক সেই রকম, অন্যদেশের বাংলাভাষীরা, বিশেষতঃ প্রতিবেশী ভারতের বাংলাভাষীদের সঙ্গে আমাদের জাতিত্বের সম্পর্কটাই বা কেমন হবে? সব সময় আমরা দোদুল্যমানতায় ভুগেছি। কাগজে-কলমে বলেছি এক, বাস্তবে করেছি আরেক। তা-ও কোনও দিক থেকেই সিংহভাগের ঐকমত্য পায়নি। শুধু তা-ই নয়, আমরা এসব নিয়ে মারামারি-কাটাকাটিও করেছি বিস্তর। অথচ আবেগ ও জেদ পরিহার করলে আমরা যা চাই, একটি স্বতন্ত্র জাতি নির্মাণ, সেটা খুব সহজ কাজ। কারণ, বাংলাদেশের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ বাংলাভাষী, শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী, গোটা দেশের ভূ-প্রকৃতি, গোত্রীয় ও সামাজিক ঐতিহ্য, সৌন্দর্যবোধ, কৃষি, শিল্প, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, এবং টিকে থাকা ও বিকশিত হওয়ার পুরুষানুক্রমিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসও একই। এত সমিল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানবগোষ্ঠীর দেশ এই পৃথিবীতে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র। কেবলই সংকীর্ণ একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি, আবেগের আতিশয্য এবং জেদ আমাদের এই অনন্য সুযোগকে কাজে লাগাতে দেয়নি। আমরা একদল চেয়েছি ভাষা হবে আমাদের জাতিগঠনের একমাত্র উপাদান, কেউ চেয়েছি ধর্ম করবে সেই কাজটি। এবং এ নিয়ে লড়াই করে চলেছি পরস্পরের বিরুদ্ধে। খুব কম লোকই ভেবেছি, এ দুটো দৃষ্টিভঙ্গিই সমান অদূরদর্শী এবং বাস্তবায়ন-অযোগ্য। বরং এ দুটি শুধু নয়, আরো যেসব আপাতঃক্ষুদ্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে সবগুলোর সমন্বয়েই একটি জাতি গঠন করার চেষ্টা করা উচিত ছিল। আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতি নিয়ে। প্রথম প্রশ্ন তোলা যায়, এই যে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছি আমরা, যার কেন্দ্রবিন্দু ১৯৭১ সাল, কিন্তু পরিধি অতীতে শত-শত বছর পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত, এবং বর্তমান পেরিয়ে অনি:শেষ ভবিষ্যতগামী, সেটা কার যুদ্ধ? ১৯৭১ সালের কথাই যদি ধরি, এই যুদ্ধ কারা করেছে? মূলতঃ বাংলাভাষীরাই এ যুদ্ধের নায়ক। কিন্তু ভিন্নভাষীদের অবদানও তাদের সংখ্যা ও যোগ্যতানুপাতে একেবারে নগণ্য নয়। আবার, এই যুদ্ধ প্রধানতঃ ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা করেছে। কিন্তু অন্য ধর্মাবলম্বীদের অংশগ্রহণ ও সমর্থনও প্রশংসনীয় মাত্রার। এখান থেকে, বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে, এ উপসংহার টানা যায় যে, আমাদের জাতিগঠনে ভাষা ও ধর্ম, অর্থাৎ বাংলা ভাষা এবং ইসলাম ধর্ম, উভয় উপাদানকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা উচিত, এবং তা এমনভাবে করতে হবে যেন অন্য ভাষা ও ধর্মও যোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্ব পায়। ভাষা ও ধর্ম পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, সুতরাং এ দুটি উপাদানকে সেভাবে উপস্থাপন করা উচিত হবে না। এই সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার পর আমরা বলতে পারি যে, আমরা প্রধানতঃ বাংলাভাষী, সেজন্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার বাংলাভাষীদের সঙ্গে আমাদের অনেক সাযুজ্য বিদ্যমান, তা সত্ত্বেও আরো অনেক কারণে আমরা তাদের থেকে স্বতন্ত্র। আমরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেজন্য পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, আরব প্রভৃতি দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের কিছু কিছু শক্তিশালী সমিলতা রয়েছে, এতদসত্ত্বেও আমরা বহুবিধ কারণে তাদের থেকে আলাদা, ঠিক যেমন এদেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা আলাদা অন্যদেশের একই ধর্মাবলম্বীদের থেকে। আমাদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইতিহাস, আমাদের জীবনযাপন ও জীবিকা, আমাদের মাটি ও ফসল, আবহাওয়া ও ঋতুবৈচিত্র্য, আমাদের সৌন্দর্যবোধ ও শিল্পচেতনা, সাহিত্য ও সঙ্গীত, প্রভৃতি অসংখ্য উপাদানও অন্য কোনও না কোনও দেশ ও জাতির সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে সাযুজ্যপূর্ণ, কিন্তু সব মিলিয়ে যে একক ও পূর্ণ আদল তা সম্পূর্ণ আমাদের নিজস্ব, অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়ের একটি পর্যবেক্ষণ এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে ‘দেশ-রাষ্ট্র-ইতিহাস বদলে গেলে সাহিত্যও বদলে যায় কি না’ এবং ‘বাংলাদেশের সাহিত্যে এমন কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে যাকে বাংলাদেশি বলে চেনা যায় আবার পশ্চিমবঙ্গেরও সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে, যাকে পশ্চিমবঙ্গীয় বলে চেনা যায়। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো কী’ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের সাহিত্য দুটোই বাংলা ভাষায় লেখা হলেও এক সাহিত্য নয়। এপার বাংলা ওপার বাংলা বা এক বাংলা এসব সেন্টিমেন্টাল কথা দিয়ে সাহিত্যের ইতিহাস নির্ধারণ হয় না। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পর এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর, অর্থাৎ সুদীর্ঘ ষাট বছরে যে ইতিহাসের মধ্য দিয়ে দুটি দেশ অগ্রসর হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্য পশ্চিমবঙ্গের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এটাকে ভাবাবেগ দিয়ে বোঝা যাবে না। …পশ্চিমবঙ্গ ভারত ইউনিয়ন নামক বিশাল উপমহাদেশতুল্য দেশের একটা ছোট রাজ্য বা প্রদেশ। তার প্রতিবেশিত্ব যেমন বাংলাদেশের বাংলা ভাষার সঙ্গে, তেমনি তার প্রতিবেশিত্ব থাকা উচিত ভারতবর্ষের আরও অজস্র ভাষার সঙ্গে, সাংবিধানিকভাবেই যাদের সংখ্যা বাইশের ওপর। সরকার, গণতন্ত্র, সমাজ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, মিউনিসিপ্যালিটির রাজনীতি, গ্রাম পঞ্চায়েত ইত্যাদির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই ভাষাভাষীদের দৈনন্দিন জীবন। দৈনন্দিন জীবন ছাড়া গল্প-উপন্যাসের আর কোনো বিষয় নেই। সেই দৈনন্দিন জীবনই যখন রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিচ্ছায়া হয়ে ওঠে, তখনই তা সার্থক সাহিত্য হয়ে ওঠে। এখন উভয় বাংলার রাষ্ট্রব্যবস্থা, উৎপাদন ব্যবস্থা গত ষাট বছরে এতই আলাদা হয়ে গেছে, সেই আলাদাত্ব স্বীকার না করা সত্যের অপলাপ হয়।’ [সাহিত্য সাময়িকী, দৈনিক প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর ২০১২]দেবেশ রায় আরও বলেন, ‘নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের পক্ষে এই পরিমাণ মুসলিম জনগোষ্ঠী নিয়ে জীবনযাপন ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে সেই গণতন্ত্রকে গণতন্ত্রও হতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষও হতে হবে; আবার আবশ্যিকভাবে ধর্মসাপেক্ষও হতে হবে।’ তাঁর এই পর্যবেক্ষণ সাহিত্য ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে হলেও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আরও বেশি সত্য। তবে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, স্বতন্ত্র মানেই শত্রু নয়; কখনও কখনও প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে, আবার কখনও কখনও সহগামী ও বন্ধুও হতে পারে। আদান-প্রদানের দরজা-জানালা পরিস্থিতিভেদে কখনও ভিড়িয়ে রাখার প্রয়োজন হতেই পারে, কিন্তু একেবারে বন্ধ করে রাখা উচিত নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্রে রেখেই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণ করা উচিত।     আমরা এতক্ষণ জাতিগঠন নিয়েই বেশি কথা বললাম। তার কারণ এই যে, সংস্কৃতির নির্মাণ মানে আসলে জাতিসত্তারই নির্মাণ। সংস্কৃতিই জাতিসত্তাকে আদল ও আকার দেয়। কোনও সংস্কৃতি-সমৃদ্ধ জাতি সে কারণে দীর্ঘকাল পরাধীন হয়ে থাকলেও মরে যায় না। কারণ তার সংস্কৃতি তখনও বেঁচে থাকে, কিছুটা আপস করে হলেও সক্রিয় থাকে। আমরাই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। মানবদেহের সর্বত্র জালের মত বিস্তৃৃত ধমনী ও শিরার মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে উষ্ণ রক্তের স্রোতধারা, একটি মুহূর্তের জন্যেও বিরতি না দিয়ে। বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না। এমনকি যার দেহে এই মহা ধুন্দুমার কাণ্ড ঘটে চলেছে, সে-ও তা টের পায় না। সংস্কৃতিও তেমনই। মানুষের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি নড়াচড়ার মধ্যেই তার সংস্কৃতি মিশে থাকে ও প্রস্ফুটিত হয়। কিন্তু তা না বুঝতে পারে সে নিজে, না অন্যে, যদি না সচেতনভাবে লক্ষ করা হয়। সে-কারণে সংস্কৃতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মাথাব্যাথা কম। সংস্কৃতি কী, কেন, কীভাবে এর বিকাশ, বিকৃতি কিংবা ধ্বংস, এবং কী তার পরিণতি এসব নিয়ে যত ভাবনা তা সব চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী মানুষের। এই চিন্তার কারণ হলো, রক্তে যেমন রোগজীবাণু ঢুকে সৃষ্টি করতে পারে নানান রকম মারাত্মক অসুখ, ঠিক তেমনই সংস্কৃতির মধ্যেও ঢুকে যেতে পারে খারাপ সংস্কৃতি (অপ-সংস্কৃতি, বা অ-সংস্কৃতি, কিংবা বি-সংস্কৃতি, বা বিজাতীয় সংস্কৃতি) যা ধ্বংস করে ফেলতে পারে স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত সংস্কৃতিকে, এর স্বাভাবিক প্রবাহ ও বিকাশকে। সে-কারণে অপ-সংস্কৃতি রোধ এবং তার চিকিৎসার প্রয়োজন সব সময় অনুভূত হয়ে আসছে। বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তি কর্তৃক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থে সংস্কৃতিকে বিনির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পিত প্রয়াস শুরু হওয়ার পর থেকে নিজেদের সংস্কৃতিকে অপ-সংস্কৃতি ও বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে রক্ষা, এবং তার স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করতে সচেতন ও পরিকল্পিত অধ্যবসায় আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এর প্রথম ধাপ হলো নিজের সংস্কৃতিকে চেনা, এর প্রাণশক্তির উৎসকে আবিষ্কার করা। তারপর জানা অপসংস্কৃতি এবং অন্যের সংস্কৃতিকেও।

উপরে প্রথম অংশে আমরা এতক্ষণ মুক্তিযুদ্ধ, জাতিগঠন ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে যে আলোচনা করেছি তা থেকে আমাদের এ  উপলব্ধি হয়েছে যে, সংস্কৃতির মূল উৎস বেশি নয়, কিন্তু এর উপাদান বহুবিধ। এবং তার কোনটাই অগুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে একজন মানুষ বা একটি মানবগোষ্ঠীর সংস্কৃতি নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মূলত দুটি বিষয় : এক, তার ভৌগলিক অবস্থানস্থল, অর্থাৎ ভূমি ও প্রকৃতি, অর্থাৎ মাটি, অর্থাৎ দেশ; আর দেশ মানে তার ভাষা, ইতিহাস, কৃষি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ইত্যাদি। এবং দুই, তার জীবনদর্শন। যে-বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানে তার জন্ম ও বসবাস, সেখানকার মাটি, সেখানকার ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া, চাষবাস, ঋতুপরিক্রমা, জীবিকার উৎস এবং ভাষা তার সংস্কৃতি নির্মাণে যে-উপাদান সরবরাহ করে তা অনেকটা জন্মগত বিষয়ের মতই গুরুত্বপূর্ণ, এবং সেই কারণে অপরিহার্য। কিন্তু এই একই ভৌগলিক অবস্থানে থেকেও ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারে। সেটাও হয় বিভিন্ন কারণে। জীবনদর্শনের ভিন্নতা তার মধ্যে প্রধান। একেকজন মানুষ বা একেকটি মানবগোষ্ঠীর জীবন ও জগতকে দেখা, বোঝা, এবং ব্যবহার ও পরিচালনা করার দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি ভিন্নতর হয়ে যায় কেবল জীবনদর্শনের ভিন্নতার কারণেই। সেজন্যে দেখা যায়, একই মাটি, একই আবহাওয়া, একই জীবিকা এবং একই ভাষা হওয়ার পরেও স্রেফ জীবনদর্শনের ভিন্নতার কারণে সংস্কৃতি আলাদা রূপ ও রং পরিগ্রহ করে। আবার এর বিপরীত ঘটনাও আমরা ঘটতে দেখি। একই জীবনদর্শনের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য মানুষের সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে ওঠে, যার কথা আমরা ওপরে আলোচনা করেছি। একই ভৌগোলিক অবস্থান ও জীবনদর্শনের যে-কোনও দু’জন মানুষের সংস্কৃতিও সম্পূর্ণ এক হয় না, কিছু না কিছু পার্থক্য থাকেই। তার কারণ, সংস্কৃতির নির্মাণে আরও অনেক গৌণ, কিন্তু গুরুত্বহীন নয় এমন বিষয়েরও ভূমিকা থাকে, যেমন তার জীবিকা, পারিবারিক পরিবেশ, গ্রামীণ বা শাহরিক অবস্থান, আর্থিক পরিস্থিতি ইত্যাদি। আবার ভিন্ন দুই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হওয়া মানেও এই নয় যে, তারা সর্বোতভাবে পৃথক। কোনও না কোনও মিল অবশ্যই থাকবে। এই জটিলতা সচেতন ও পরিকল্পিতভাবে সংস্কৃতি বিনির্মাণ কিংবা বিকাশের কাজকে বেশ কঠিন এবং দ্বান্দ্বিক করে তোলে। ফলে সংস্কৃতি নিয়ে বিতর্কের কোনও শেষ নেই।

বাংলাদেশের মানুষ ভৌগলিক দিক থেকে সবাই একই সূত্রে আবদ্ধ হলেও, তাদের জীবনদর্শনগত ভিন্নতা রয়েছে। এখানে আছে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, এবং বিভিন্ন লোকজ জীবনদর্শনে বিশ্বাসী মানুষ ও জনগোষ্ঠী। আছে ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিকতাবাদী মানুষও। বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলামী জীবনদর্শনের অনুসারী। তবে তাদের অনেকের মধ্যে অপরাপর জীবনদর্শনেরও কিছু-কিছু প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যকার আদান-প্রদানের স্বাভাবিক ও অনিবার্য জটিলতাও। এইসব মতভিন্নতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপ-সংস্কৃতি এবং বিজাতীয় ও কৃত্রিম সংস্কৃতির আগ্রাসন। ফলে পরিস্থিতি এতটাই জটিল রূপ নিয়ে প্রতিভাত যে, আমাদের সংস্কৃতির গভীর ও নির্মোহ অধ্যয়ন ও গবেষণা-পর্যালোচনা আজ খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে।

সংস্কৃতির আদান-প্রদান কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, বরং এর মাধ্যমে সংস্কৃতি আরও ঋদ্ধ ও টেকসই হয়। কিন্তু এই উন্মুক্ত দরজা দিয়েই অনুপ্রবেশ করে অপ-সংস্কৃতি এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বিজাতীয় ও কৃত্রিম সংস্কৃতি। সুস্থ, সমৃদ্ধ ও ঘাতসহ সংস্কৃতির স্বার্থে আদান-প্রদানকে নিরুৎসাহিত না করলেও, তার জন্যে এক ধরনের বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু স্থান-কাল-পাত্রের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা ভিন্নতর হওয়ার কারণে এই আদান-প্রদান এবং বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে একমত হওয়া প্রায়ই অসম্ভব হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও, এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা, এমনকি বিতর্কও কাজটাকে সহজতর করে। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, স্বাবলম্বী, সমৃদ্ধশালী, গর্বিত ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন। সেই লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় সংস্কৃতি বিনির্মাণের এই অধ্যবসায় ও আন্দোলন আজ আমাদের অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, আমাদের ভাষা এবং ধর্ম, সংস্কৃতির নির্মাণ ও বিকাশের সবচেয়ে বড় ও অপরিহার্য দুটি উপাদান, আজ আগ্রাসনের শিকার।