রমযানে এতেকাফ : গুরুত্ব ও তাৎপর্য

37
রমযানে এতেকাফ : গুরুত্ব ও তাৎপর্য
রমযানে এতেকাফ : গুরুত্ব ও তাৎপর্য

রমযানে এতেকাফ : গুরুত্ব ও তাৎপর্য
মাওলানা এ এইচ এম আবুল কালাম আযাদ

এতেকাফ আরবী শব্দ। ‘আকফ’ মূলধাতু থেকে গঠিত। আকফ শব্দের অর্থ হলো অবস্থান করা, স্থির থাকা, যেমন আল্লাহ তায়ালার বাণী “আর তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের যৌন মিলন করো না যখন তোমরা মসজিদে এতেকাফে থাকো”। (সূরা বাকারা ১৮৭) আভিধানিক ভাবে কোনো বস্তুকে বাধ্যতামূলকভাবে ধারণ করা কিংবা কোনো বস্তুর ওপর নিজেকে দৃঢ়ভাবে আটকিয়ে রাখার নাম এতেকাফ। শরিয়তের পরিভাষায় যেই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতসহকারে নিয়মিত আদায় করা হয় এমন মসজিদে মহান আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়তসহকারে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে। দুনিয়াবী কাজকর্ম ও পরিবার পরিজন থেকে আলাদা হয়ে সওয়াবের নিয়তে মসজিদে বা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে। সকল সময় এতেকাফ জায়েয। তবে রমাদান মাসে উত্তম এবং রমাদানের শেষ দশকে কদরের উদ্দেশ্যে তা সর্বোত্তম। রাসূল স. প্রতি বছর রমাদানে এতেকাফ করেছেন এবং এতেকাফ করার জন্য সাহাবাদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন।


এতেকাফের ফজিলতঃ রমাদানের শেষ দশকে আল্লাহর অসংখ্য অগণিত রহমত উম্মতে মুহাম্মদীর উপর অবিরাম ধারায় বর্ষিত হতে থাকে। আল্লাহর রহমতে জোয়ার আসে। তাই এ দশকের এতেকাফে বিশেষ ফজিলত রয়েছে। রাসূল স. নিজেও এই দশকে এতেকাফ করেছেন এবং এতেকাফকারীদের জন্যে বহু সওয়াবের সু- সংবাদ দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন এতেকাফ করে, আল্লাহ সেই ব্যক্তি ও দোজখের মধ্যে ৩ খন্দক পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করেন। (তাবারানী ও হাকেম) প্রত্যেক খন্দক পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্বের চাইতে আরো বহুদূর।
আলী বিন হোসাইন নিজ পিতা থেকে বর্ণনা করেনঃ রাসূল স. বলেছেনঃ যে ব্যক্তি রমাদানে ১০ দিন এতেকাফ করে, তা দুই হজ্জ ও দুই ওমরার সওয়াবের সমান। (বায়হাকী)
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, এতেকাফ কারী সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেন, এতেকাফকারী গুনাহ থেকে বিরত থাকে। তাকে সকল নেক কাজের কর্মী বিবেচনা করে বহু সওয়াব দেয়া হয়। ( ইবনে মাজাহ)


এতেকাফের উদ্দেশ্যঃ
১. আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা
আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট হওয়া ও আল্লাহ কেন্দ্রিক ব্যতিব্যস্ততা যখন অন্তর সংশোধিত ও ঈমানি দৃঢ়তা অর্জনের পথ, কেয়ামতের দিন তার মুক্তিও বরং এ পথেই, তাহলে এতেকাফ হল এমন একটি ইবাদত যার মাধ্যমে বান্দা সমস্ত সৃষ্টি-জীব থেকে আলাদা হয়ে যথাসম্ভব প্রভুর সান্নিধ্যে চলে আসে। বান্দার কাজ হল তাঁকে স্মরণ করা, তাঁকে ভালোবাসা ও তাঁর ইবাদত করা। সর্বদা তার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা, এরই মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক দৃঢ় ও মজবুত হয়।


২. পাশবিক প্রবণতা এবং অহেতুক কাজ থেকে দুরে থাকারোজার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন অতিরিক্ত পানাহার ও যৌনাচারসহ পশু প্রবৃত্তির বিবিধ প্রয়োগ থেকে, অনুরূপভাবে তিনি এতেকাফের বিধানের মাধ্যমে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন অহেতুক কথা-বার্তা, মন্দ সংস্পর্শ, ও অধিক ঘুম হতে ।
এতেকাফের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ অর্থে আল্লাহর জন্য নিবেদিত হয়ে যায়। নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির ও দোয়া ইত্যাদির নির্বাধ চর্চার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের অফুরান সুযোগের আবহে সে নিজেকে পেয়ে যায়।


৩. শবে কদর তালাশ করাএতেকাফের মাধ্যমে শবে কদর খোঁজ করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মূল উদ্দেশ্য ছিল, আবু সায়ীদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত হাদিস সে কথারই প্রমাণ বহন করে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আমি প্রথম দশকে এতেকাফ করেছি এই (কদর) রজনী খোঁজ করার উদ্দেশ্যে, অতঃপর এতেকাফ করেছি মাঝের দশকে, অত:পর মাঝ-দশক পেরিয়ে এলাম, তারপর আমাকে বলা হল, (কদর) তো শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ এতেকাফ করতে চায় সে যেন এতেকাফ করে, অত:পর লোকেরা তাঁর সাথে এতেকাফ করল। [মুসলিম: হাদিস নং ১১৬৭]


৪. মসজিদে অবস্থানের অভ্যাস গড়ে তোলাএতেকাফের মাধ্যমে বান্দার অন্তর মসজিদের সাথে জুড়ে যায়, মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। হাদিস অনুযায়ী যে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের ছায়ার নীচে ছায়া দান করবেন তাদের মধ্যে একজন হলেন ওই ব্যক্তি মসজিদের সাথে যার হৃদয় ছিল বাঁধা।


৫. দুনিয়া ত্যাগ ও বিলাসিতা থেকে দুরে থাকা এতেকাফকারী যেসব বিষয়ের স্পৃক্ততায় জীবন যাপন করত সেসব থেকে সরে এসে নিজেকে মসজিদে আবদ্ধ করে ফেলে। এতেকাফ অবস্থায় দুনিয়া ও দুনিয়ার স্বাদ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, ঠিক ঐ আরোহীর ন্যায় যে কোন গাছের ছায়ার নীচে বসল, অতঃপর সেখান থেকে উঠে চলে গেল।


৬. ইচ্ছাশক্তি প্রবল করা এবং প্রবৃত্তিকে খারাপ অভ্যাস ও কামনা-বাসনা থেকে বিরত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা কেননা এতেকাফ দ্বারা খারাপ অভ্যাস থেকে বিরত থাকার ট্রেন্ড গড়ে উঠে। এতেকাফ তার জন্য সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় নিজেকে ধৈর্য্যরে গুণে গুণান্বিত করতে ও নিজের ইচ্ছাশক্তিকে শানিত করতে। এতেকাফ থেকে একজন মানুষ সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে বের হয়ে আসার সুযোগ পায়। যা পরকালে উপকারে আসবেনা তা থেকে বিরত থাকার ফুরসত মেলে।


৭. মসজিদে এতেকাফের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশে নিজেকে আবদ্ধ করে নেওয়ার কারণে মুসলমানের অন্তরের কঠোরতা দূরীভূত হয়, কেননা কঠোরতা সৃষ্টি হয় দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও পার্থিবতায় নিজেকে আরোপিত করে রাখার কারণে। মসজিদে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখার কারণে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসায় ছেদ পড়ে এবং আত্মিক উন্নতির অভিজ্ঞতা অনুভূত হয়। মসজিদে এতেকাফ করার কারণে ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকে, ফলে এতেকাফকারী ব্যক্তির আত্মা নিম্নাবস্থার নাগপাশ কাটিয়ে ফেরেশতাদের স্তরের দিকে ধাবিত হয়। ফেরেশতাদের পর্যায় থেকেও বরং ঊর্ধ্বে ওঠার প্রয়াস পায়। কেননা ফেরেশতাদের প্রবৃত্তি নেই বিধায় প্রবৃত্তির ফাঁদে তারা পড়ে না। আর মানুষের প্রবৃত্তি থাকা সত্ত্বেও সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর জন্য একাগ্রচিত্ত হয়ে যায়।
৮. এতেকাফের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে।

৯. বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াতের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

১০. ঐকান্তিকভাবে তওবা করার সুযোগ লাভ হয়।

১১. তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়া যায়।

১২. সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যায়।
এতেকাফের প্রকারঃ এতেকাফ তিন প্রকার। ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্কাদা, মুস্তাহাব বা নফল। মান্নতের এতেকাফ আদায় করা ওয়াজিব। যথা- কেউ এরূপ মান্নত করল যে, আমার অমুক কাজটি উদ্ধার হলে আমি এতেকাফ করব। তাহলে কাজ উদ্ধার হলে এতেকাফ আদায় করা ওয়াজিব হয়ে পড়বে। আদায় না করলে গুনাহগার হবে। রাসূল স. বলেছেনঃ কোন ব্যক্তির মান্নত যদি আল্লাহর আনুগত্যের জন্য হয়, তা যেন পূরণ করা হয়। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিতঃ উমর রা. রাসূল স. কে জিজ্ঞেস করেন, আমি জাহেলিয়াতের যুগে মসজিদে হারামে এক রাত এতেকাফ করার নিয়ত করেছিলাম। রাসূল স. বলেন, তোমার মান্নত পূরণ করো।
রমাদান মাসের শেষ দশকে এতেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে আলাল কেফায়া। কারণ রাসূল স. সর্বদা এ দিনগুলোতে এতেকাফ করতেন এবং সাহাবাগণকেও এতেকাফ করার জন্যে উৎসাহিত করতেন। এ ছাড়া বছরের যে কোন দিন যে কোন মুহূর্তে এতেকাফ করাকে নফল বা মুস্তাহাব এতেকাফ বলে।


এতেকাফের শর্তঃ এতেকাফের অনেকগুলো শর্ত রয়েছে । শর্ত গুলো নিম্নরূপ-
১. এতেকাফের জন্য কেউ কেউ রোজার শর্ত করেছেন, কিন্তু বিশুদ্ধ মত হল রোজা শর্ত নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত আছে যে তিনি কোন এক বছর শাওয়ালের প্রথম দশকে এতেকাফ করেছিলেন, আর এ দশকে ঈদের দিনও আছে। আর ঈদের দিনে তো রোজা রাখা নিষিদ্ধ।
২. এতেকাফের জন্য মুসলমান হওয়া শর্ত। কেননা কাফেরের ইবাদত গ্রহণযোগ্য হয় না।
৩. এতেকাফকারীকে বোধশক্তিসম্পন্ন হতে হবে, কেননা নির্বোধ ব্যক্তির কাজের কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, আর উদ্দেশ্য ব্যতীত কাজ শুদ্ধ হতে পারে না।
৪. ভালো-মন্দ পার্থক্য করার জ্ঞান থাকতে হবে, কেননা কম বয়সী, যে ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না, তার নিয়তও শুদ্ধ হয় না।
৫. এতেকাফের নিয়ত করতে হবে, কেননা মসজিদে অবস্থান হয়তো এতেকাফের নিয়তে হবে অথবা অন্য কোনো নিয়তে। আর এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য করার জন্য নিয়তের প্রয়োাজন।
উপরুন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামতো বলেছেন : প্রত্যেক কাজের নির্ভরতা নিয়তের উপর, যে যা নিয়ত করবে সে কেবল তাই পাবে। ( বুখারি : ১)
৬. এতেকাফ অবস্থায় মহিলাদের হায়েজ-নিফাস থেকে পবিত্র থাকা জরুরি, কেননা এ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করা হারাম, অবশ্য এস্তেহাজা অবস্থায় এতেকাফ করা বৈধ। আয়েশা রা. আনহা বলেন : রাসুলুল্লাাহ সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাঁর স্ত্রী-গণের মধ্য হতে কেউ একজন এতেকাফ করেছিলেন এস্তেহাজা অবস্থায়। তিনি লাল ও হলুদ রঙ্গের স্রাব দেখতে পাচ্ছিলেন, আমরা কখনো তার নীচে পাত্র রেখে দিয়েছি নামাজের সময়। (বুখারি ২০৩৭)
এস্তেহাজাগ্রস্তদের সাথে অন্যান্য বেধীগ্রস্তদেরকে মেলানো যায়, যেমন যার বহুমূত্র রোগ বিশিষ্ট ব্যক্তি আছে, তবে শর্ত হল মসজিদ যেন অপবিত্র না হয়।
৭. গোসল ফরজ হয় এমন ধরনের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হতে হবে। অপবিত্র লোক মসজিদে অবস্থান করা হারাম। যদিও কোন কোন আলেম ওজু করার শর্তে মসজিদে অবস্থান বৈধ বলেছেন। আর যদি অপবিত্রতা, যৌন স্পর্শ অথবা স্বামী -স্ত্রীর মিলনের ফলে হয়, তবে সকলের মতে এতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর যদি স্বপ্নদোষের কারণে হয়, তাহলে কারোর মতে এতেকাফ ভঙ্গ হবে না। আর যদি হস্তমৈথুনের কারণে হয় তা হলে সঠিক মত অনুসারে এতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
৮. এতেকাফ মসজিদে হতে হবে : রাসূল স. বলেনঃ যে মসজিদে জামায়াত হয় সে মসজিদ ছাড়া এতেকাফ হবে না। ( আবু দাউদ) এ ব্যাপারে সকল আলেম একমত যে এতেকাফ মসজিদে হতে হবে, তবে জামে মসজিদ হলে উত্তম কেননা এমতাবস্থায় জুমার নামাজের জন্য এতেকাফকারীকে মসজিদ থেকে বের হতে হবে না।


এতেকাফের সময়ঃ নফল বা মুস্তাহাব এতেকাফ সামান্য সময়ের জন্যেও হতে পারে। অর্থাৎ যদি কেউ এক মিনিট বা অর্ধ মিনিটের জন্যেও এতেকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করে, তাহলে তা এতেকাফ হিসেবে গণ্য হবে। এ কারণেই উলামায়ে কেরাম বলেন যে, নামাযের জন্যে মসজিদে প্রবেশের সাথে সাথে এতেকাফের নিয়ত করে নিবে, তাতে নামাযের পাশাপাশি নফল এতেকাফের সওয়াবের অধিকারী হওয়া যাবে। সুন্নতে কেফায়া এতেকাফের সময় হচ্ছে রমাদানের ২০ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত। ওয়াজিব এতেকাফের জন্য ন্যুনতম সময় হল একদিন। একদিনের কম সময়ের জন্যে এতেকাফের মান্নত হয় না। এর অধিক যত দিন মনে চায়, তত দিনের মান্নত করা যায়। কিন্তু যে সকল দিনে রোযা রাখা নিষেধ ঐ সকল দিনে এতেকাফের মান্নত করা জায়েয নয়। কারণ মান্নতের এতেকাফের সময় রোযাও রাাখতে হয়। কারণ রোযা ব্যতীত মান্নতের এতেকাফ আদায় হয় না। যদি শুধু একদিনের এতেকাফের মান্নত করে, তাহলে তার সাথে রাত শামিল হবে না। তবে যদি রাত দিন উভয়ের নিয়ত করে বা একত্রে কয়েক দিনের মান্নত করে, তাহলে রাতও শামিল হবে। দিন বাদ দিয়ে শুধু রাতে এতেকাফের মান্নত হয়না। ( কিভাবে কাটাবেন মাহে রমাদান: জাস্টিস মুফতী মুহাম্মদ তাকী উসমানী)


এতেকাফ কারীর জন্য যে সমস্ত কাজ করা জায়েযঃ 
-এতেকাফকারীর জন্য মসজিদে পানাহার ও ঘুমানোর অনুমতি আছে। তবে মসজিদের পবিত্রতা রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এ ব্যাপারে সকল ইমামদের ঐক্যমত রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত; কেননা আল্লাহর প্রতি একাগ্রচিত্ত এবং একনিষ্ঠভাবে মনোনিবেশের জন্য কম খাওয়া কম ঘুমানো সহায়ক বলে বিবেচিত।
-জরুরী কাজের জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া। নিজ পরিবারের লোকদেরকে বিদায় জানানোর জন্য বের হওয়া জায়েয আছে। কেননা হযরত সফিয়া থেকে বর্ণিত হাদীওস অনুরূপ ঘটনা জানা যায়। তবে বিনা প্রয়োজনে বের না হওয়াই ভালো। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ এতেকাফ কারীর জন্য সুন্নাত হলো, রোগী দেখতে না যাওয়া, জানাযায় অংশ গ্রহণ না করা, স্ত্রী স্পর্শ না করা এবং সহবাস না করা এবং খুব বেশী প্রয়োজন না হলে মসজিদ থেকে বের না হওয়া। ( আবু দাউদ)
-গোসল করা, চুল আঁচড়ানো, তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার, ভাল পোশাক পড়া, এ সবের অনুমতি আছে। আয়েশা রা. আনহার হাদিসে এসেছে: তিনি মাসিক অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাথার কেশ বিন্যাস করে দিতেন, যখন রাসুল স. মসজিদে এতেকাফরত অবস্থায় থাকতেন, আয়েশা রা. তার কক্ষে থাকা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথার নাগাল পেতেন। [বুখারি : ২০৪৬]
-এতেকাফকারীর পরিবার তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে, কথা বলতে পারবে, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ এতেকাফকালীন তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন। কিন্তু সাক্ষাৎ দীর্ঘ না হওয়া বাঞ্ছনীয়।


যে কাজ দ্বারা এতেকাফ ভঙ্গ হয়ঃ 
 এতেকাফের স্থান থেকে শরীয়তসম্মত প্রয়োজন বা স্বাভাবিক প্রয়োজন ছাড়া বের হয়ে গেলে তবে শরীয়ত সম্মত প্রয়োজন হলে মসজিদের বাইরে বের হওয়া যায়।
 স্ত্রী সহবাস করলে, চাই বীর্যপাত হোক বা না হোক। ইচ্ছাকৃত হোক বা ভূলক্রমে হোক। সহবাসের আনুষাঙ্গিক কাজ যেমন চুম্বন, আলিঙ্গন ইত্যাদির কারণে বীর্যপাত হলে এতেকাফ ফাসেদ হয়ে যাবে। তবে চুম্বন ইত্যাদির কারণে বীর্যপাত না হলে এতেকাফ বাতিল হবে না। তবে এতেকাফ অবস্থায় এসব করা হারাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন “আর তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের যৌন মিলন করো না যখন তোমরা মসজিদে এতেকাফে থাকো”। (সূরা বাকারা ১৮৭)
 পাগল হওয়া।
 স্ত্রীলোকের হায়েজ নেফাস হওয়া।
 ধর্মত্যাগী (মুরতাদ) হওয়া।


মসজিদ থেকে বের হওয়ার বিধানঃ
১. এতেকাফকারী যদি বিনা প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হয় তাহলে তার এতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।২. আর এতেকাফের স্থান থেকে যদি মানবীয় প্রয়োজন মিটানোর জন্য বের হয় তাহলে এতেকাফ ভঙ্গ হবে না।৩. মসজিদে থেকে পবিত্রতা অর্জন সম্ভব না হলে মসজিদ থেকে বের হওয়ার অনুমতি আছে।৪. বাহক না থাকার কারণে এতেকাফকারীকে যদি পানাহারের প্রয়োাজনে বাইরে যেতে হয় অথবা মসজিদে খাবার গ্রহণ করতে লজ্জা বোধ হয়, তবে এরূপ প্রয়োাজনে বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে।৫. যে মসজিদে এতেকাফে বসেছে সেখানে জুমার নামাজের ব্যবস্থা না থাকলে জুমার নামাজ আদায়ের প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া ওয়াজিব, এবং আগে ভাগেই রওয়ানা হওয়া তার জন্য মুস্তাহাব ।৬. ওজরের কারণে এতেকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারে। ছাফিয়্যা রা. থেকে বর্ণিত হাদিস এর প্রমাণ: ছাফিয়্যা রা. আনহা রমাদানের শেষ দশকে এতেকাফস্থলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কতক্ষণ কথা বললেন, অতঃপর যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে বিদায় দিতে উঠে দাঁড়ালেন। (বুখারি : ২০৩৫)৭.কোন নেকির কাজ করার জন্য এতেকাফকারীর মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়। যেমন রোগী দেখতে যাওয়া, জানাজায় উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি। এ মর্মে আয়েশা রা. আনহা বলেন: এতেকাফকারীর জন্য সুন্নত হল, সে রোগী দেখতে যাবে না, জানাযায় উপস্থিত হবে না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না ও তার সাথে কামাচার থেকে বিরত থাকবে এবং অতি প্রয়োাজন ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হবে না। (আবু দাউদ, হাদিস নং ২৪৭৩)৮.এতেকাফ-বিরুদ্ধ কোন কাজের জন্য এতেকাফকারীর মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়, যেমন ক্রয়-বিক্রয়, স্বামী-স্ত্রীর মিলন ইত্যাদি।


এতেকাফকারীর জন্য যা মাকরূহঃ এতেকাফ অবস্থায় চুপ থাকলে সওয়াব হয়; এই মনে করে চুপ থাকা মাকরূহে তাহরীমী। বিনা প্রয়োজনে পার্থিব কোন কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরূহে তাহরীমী। যেমন কেনাবেচা করা ইত্যাদি। তবে একান্ত প্রয়োজনবশত যেমন ঘরে খাবার নেই এবং সে ব্যতিত অন্য কোন বিশ্বস্ত মানুষও নেই- এরূপ অবস্থায় মসজিদে মালপত্র উপস্থিত না করে কেনাবেচার চুক্তি করতে পারে।


এতেকাফের মুস্তাহাব বিষয়ঃ১. বেশী বেশী নামায পড়া, কুরআন তেলাওয়াত, অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ তাফসীর পড়া এবং ইসলামী সাহিত্য ও বই পুস্তক পড়া, অর্থাৎ দ্বীনী এলেম অর্জন করা।২. বেহুদা কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। ঝগড়া ঝাটি এবং গাল-মন্দ না করা।৩. মসজিদের একটি অংশে অবস্থান করা। নাফে রা. থেকে বর্ণিত, আব্দুল্লাহ বিন উমর আমাকে মসজিদে নববীতে রাসূলুল্লাহর স. এতেকাফের সুনির্দিষ্ট স্থানটি দেখিয়েছেন। ( সহীহ মুসলিম)


মহিলাদের এতেকাফঃ পুরুষের ন্যায় মহিলারাও এতেকাফ করতে পারবে। ঘরের যে অংশে সাধারণত নামায পড়া হয় সেখানে যদি পর্দার যাবতীয় শর্তাবলী পাওয়া যায় এবং সার্বিক দিক বিবেচনা করে নিরাপদ মনে হয় তাহলে সেখানে এতেকাফের জন্যে নির্দিষ্ট করে নিবে। তারপর সেখানে বসে ইবাদত বন্দেগী করা শুরু করে দিবে। মহিলাদের জন্যে স্বামীর অনুমতি ব্যতিত এতেকাফ করা ঠিক না। স্বামী উপস্থিত থাকলে তার অনুমতি নিয়ে এতেকাফ করবে। স্বামীর খেদমতের প্রয়োজন হলে এতেকাফে বসবে না। তদ্রুপ শিশুর তত্ত্বাবধান ও যুবতী কন্যার প্রতি খেয়াল রাখার আবশ্যকতা থাকলে এতেকাফে না বসাই ভাল। তবে এ জাতীয় সমস্যা না থাকলে স্বামীর জন্যে উচিত হবে স্বীয় স্ত্রীকে নিজ ঘরে এতেকাফের অনুমতি প্রদান করা, এবং এই বিরাট পুণ্যের কাজে অনুপ্রাণিত করা। কারণ এতে পরকালীন উপকার ছাড়াও বৈষয়িক অনেক উপকারিতা রয়েছে। 
এতেকাফ এমন এক বৈধ নির্জনতা যেখানে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত, জিকির ও আনুগত্যের উদ্দেশ্যে নিজের আত্মা ও সত্তাকে একান্তভাবে নিয়োজিত করে এবং নামায, রোযা, কুরআন তেলাওয়াত, ইসলামী জ্ঞান চর্চা ও গবেষণায় নিজেকে সম্পূর্ণ ব্যস্ত রাখে। একই কারণে তিনি দুনিয়ার সকল কাজ ও ব্যস্ততা থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দূরে থাকেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের পথে যেন কোন দুনিয়াবী চিন্তা ও কাজ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে। এতেকাফ কিছুতেই বৈরাগ্যবাদ নয়। বৈরাগ্যবাদ স্থায়ী জিনিস আর এতেকাফ হচ্ছে সাময়িক। তাই এতেকাফের বিরাট সওয়াব ও মর্যাদা লাভ করার জন্য সবারই সচেষ্ট হওয়া দরকার।

লেখক:বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও টিভি আলোচক, .

Email: azad91bd@gmail.com, ০১৭৮১৩৫৮৯২৬